বহিস্থ তহবিলের স্বল্পমেয়াদি উৎস

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং - অর্থায়নের উৎস | NCTB BOOK

স্বল্পমেয়াদ বলতে ১ বছরের কম সময়কে বুঝানো হয়। একটি প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ অর্থায়ন মূলত স্বল্পমেয়াদি উৎস হতে সংগ্রহ করা হয়, যা এক বছর বা তার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে পরিশোধযোগ্য। স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কিছু সুবিধা থাকে। যেমন :

প্রথমত, স্বল্পমেয়াদি উৎস হতে অর্থ সংস্থানের খরচ তুলনামূলকভাবে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দুইই হতে পারে। যেমন: বাণিজ্যিক ব্যাংক হতে গৃহীত ঋণের জন্য স্বল্পমেয়াদে তুলনামূলকভাবে সুদের হার বেশি প্রদান করতে হয়। আবার বিভিন্ন ঋণমুক্ত উৎস যেমন: বাকিতে পণ্য ক্রয়, বকেয়া মজুরির মাধ্যমে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প সময়ের জন্য অর্থের সংস্থান করতে পারে। যার কোনো মূলধনি খরচ নেই। (মূলধনি খরচ সম্পর্কে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে বিস্তারিত জানতে পারব।

দ্বিতীয়ত, স্বল্পমেয়াদি অর্থ আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াটি সবচেয়ে দ্রুততম ও সরল প্রক্রিয়া। পক্ষান্তরে, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থ আদান-প্রদানের জন্য অনেক সময় ব্যয় ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।

তৃতীয়ত, যেসব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পণ্য দ্রব্যের চাহিদা এক বছর সময়ের মধ্যে অতি দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ও অর্থায়নের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা যায় না। যেমন: ফ্যাশন হাউসগুলোর চাহিদার দ্রুত পরিবর্তনশীলতার কারণে পণ্য উৎপাদনের জন্য স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ  করে, ফলে একসাথে কম পরিমাণে উৎপাদন করায় এদের অর্থ বিনিয়োগের পরিমাণও কম হয়। এ ধরনের ব্যবসায় স্বল্পমেয়াদি উৎস হতে অর্থসংস্থান করা সুবিধাজনক।

এবার আমরা স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নের উৎসগুলো আলোচনা করব। এই মেয়াদের অর্থায়নের উৎসগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক এই দুভাগে ভাগ করা যায়। নিচে আমরা প্রথমে স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নের প্রাতিষ্ঠানিক উৎস ও পরে অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস আলোচনা করব।

১. স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নের প্রাতিষ্ঠানিক উৎস

ক) প্রাপ্য বিল বাট্টাকরণ

পণ্য যখন বাকিতে ক্রয় করা হয়, তখন ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান বিক্রেতাকে একটি দলিলের মাধ্যমে এই মর্মে অঙ্গীকার করে যে নির্দিষ্ট মেয়াদ (সাধারণত তিন মাস) শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পণ্য ক্রয় বাবদ পরিশোধ করবে। এই দলিলকে বিনিময় বিল বলা হয়। বিক্রেতার কাছে এই বিলটি একটি প্রাপ্য বিল। এই ধরনের বিল বাণিজ্যিক ব্যাংকে ভাঙ্গিয়ে বা বাট্টা করে নগদ অর্থ সংগ্রহ করা যায়। ধরা যাক, একজন ক্রেতা জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে ৫০০ টাকার পণ্যদ্রব্য বাকিতে ক্রয় করে বিক্রেতাকে বিনিময় বিল নামক দলিলে এই মর্মে অঙ্গীকার করে যে, সে মার্চ ৩০ তারিখের মধ্যে বিক্রেতাকে ৫০০ টাকা পরিশোধে বাধ্য থাকবে। এ অবস্থায় বিক্রেতার যদি এখনই অর্থের প্রয়োজন হয়, তখন বিক্রেতা এই বিনিময় বিলটিকে মেয়াদ পূর্তির পূর্বেই যেকোনো ব্যাংকের কাছে বিক্রয় করে বিনিময় বিলের সমমূল্য থেকে কিছু কম যেমন: ৫০০ টাকার বিলে ৩% বাট্টার হারে ৪৮৫ টাকা নগদ সংগ্রহ করতে পারে।

খ) প্রদেয় বিল

উপরের উদাহরণে বিনিময় বিল বিক্রেতার দৃষ্টিতে একটি প্রাপ্য বিল, যা ক্রেতার দৃষ্টিতে প্রদেয় বিল ও একটি স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নের উৎস। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান যখন কাঁচামাল, উৎপাদনসামগ্রী ইত্যাদি বাকিতে ক্রয় করে, তখন সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবসায়ে অর্থসংস্থান হয়। কারণ বাকিতে ক্রয়ের সুবিধা না পেলে নগদে পণ্য ক্রয় করতে অর্থের প্রয়োজন হতো, যার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদসহ ফেরত দিতে হতো।

গ) স্বল্পমেয়াদি ব্যাংক ঋণ

স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণ একটি প্রধান উৎস। এ ধরনের ব্যাংক ঋণ বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন: সাধারণত স্বল্পমেয়াদি ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ান্তে সুদসহ আসল একসাথে পরিশোধ করা হয়। অনেক সময় ব্যাংক ঋণগ্রহীতাকে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই ঋণের কিয়দংশ বা সম্পূর্ণ অংশ পরিশোধে উৎসাহ প্রদানের নিমিত্তে মোট পরিমাণের উপর কিছু ছাড় প্রদান করে। যেমন: একজন ঋণ গ্রহীতার ৬ মাস পর প্রদেয় ৬০০০ টাকা যদি ৬মাসের আগে পরিশোধ করে তবে ঋণগ্রহীতা ব্যাংককে ২% কম অর্থ প্রদান করতে পারে অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা ব্যাংককে ৫,৮৮০ টাকা প্রদান করবে। এছাড়া ঋণগ্রহীতা যদি নির্দিষ্ট সময়ের ভিত্তিতে ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার না করে ব্যাংক চাওয়া মাত্রই ঋণ পরিশোধের শর্তে ঋণ গ্রহণ করে, তবে সেটিকে চাহিবামাত্র প্রদেয় ঋণ বলা হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নের বিকল্প উৎস আছে তারা স্বল্প খরচে এই উৎস ব্যবহার করতে পারে।

ঘ) ব্যাংক জমাতিরিক্ত উত্তোলন

স্বল্পমেয়াদি ব্যাংক ঋণের আর একটি উৎস ব্যাংক জমাতিরিক্ত উত্তোলন। সব প্রতিষ্ঠানই মূলত চলতি হিসাবের মাধ্যমে পাওনা আদায় ও দেনা পরিশোধ করে থাকে। এ ধরনের ব্যাংক হিসাব সাধারণত মক্কেলকে বা প্রতিষ্ঠানকে জমার অতিরিক্ত উত্তোলনের সুযোগ প্রদান করে, তবে জমার অতিরিক্ত উত্তোলনের সর্বোচ্চ পরিমাণ ব্যাংক সীমাবদ্ধ করে দেয়। সাধারণত যেসব প্রতিষ্ঠানে বছরের কিছু সময়ে বিক্রয় কমে যায়, সেই সময়ে এ ধরনের উৎস থেকে অর্থায়ন একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরি সারা বছর তার উৎপাদন, গুদামজাতকরণ, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কার্যে অর্থব্যয় করে কিন্তু মূলত গ্রীষ্মকালে আইসক্রিম বিক্রি বেশি হয়, ফলে বছরের অন্যান্য সময়ে অর্থায়নের জন্য এই উৎসটি ব্যবহৃত হয়। সাধারণত অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত ঋণের সুদ প্রদান করতে হয়, কিন্তু এ ধরনের ঋণের সুদ শুধু যখন থেকে জমাতিরিক্ত উত্তোলিত অর্থ ব্যবহার করা হয়, কেবল তখন থেকেই সুদ দিতে হয়। তবে এ ধরনের ঋণের সুদের হার অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি উৎস হতে বেশি এবং এটি ব্যাংক চাওয়ামাত্রই ঋণগ্রহীতাকে পরিশোধ করতে হয়।

ঙ)ক্ষুদ্র ঋণ

এ ধরনের ঋণ সাধারণত কৃষিনির্ভর ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের চলতি মূলধনের চাহিদা পূরণের নিমিত্তে প্রদান করা হয়। যেমন: কুটির শিল্প ব্যবস্থাপনা, কৃষি উপাদান ক্রয়, হ্যাচারি বা খামার পরিচালনা ইত্যাদি। গ্রামীণ ব্যাংক, যুব উন্নয়ন ব্যাংক, সমবায় ব্যাংকগুলো এ ধরনের ঋণ প্রদান করে থাকে। এই ঋণগুলো ধাপে ধাপে উদ্দেশ্য অর্জনের ভিত্তিতে প্রদান করা হয়।

২. স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নের অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস

ক) বাণিজ্যিক পত্র

কারবারি প্রতিষ্ঠান অর্থায়নের জন্য নির্দিষ্ট সময়াস্তে লাভসহ আসল অর্থ ফেরত প্রদানের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে এই বাণিজ্যিক পত্র (Commercial Paper) বিক্রয় করে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বাণিজ্যিক পত্র বিক্রয়ে জামানত হিসাবে কাজ করে। সাধারণত যে সকল ব্যক্তির সাময়িক সময়ের জন্য কিছু অব্যবহার্য অর্থ থাকে, তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বিকল্প হিসাবে এই বাণিজ্যিক পত্র ক্রয় করে। সাধারণত খ্যাতিমান ব্যক্তি, বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিমা কোম্পানি, পেনশন তহবিল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক পত্র বিক্রয় করে সাময়িক সময়ের জন্য অর্থায়ন করতে পারে।

খ) ক্রেতা হতে অগ্রিম গ্রহণ

অনেক সময় বিশ্বস্ত ও স্থায়ী ক্রেতারা ভবিষ্যৎ ক্রয়ের মোট মূল্যের সম্পূর্ণ বা কিয়দংশ অগ্রিম প্রদান করে ফলে বিক্রেতা সাময়িক সময়ের জন্য অর্থ সংস্থান করতে পারে। 

গ) মজুত মাল বন্ধকীকরণ

স্বল্পমেয়াদি অর্থ সংস্থানের জন্য মজুতপণ্য ব্যবহার করা যায়। কোনো প্রতিষ্ঠান অর্থ সংস্থানের জন্য কোনো স্বনামধন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে তার মজুতপণ্য জামানত বা বন্ধক রেখে ঋণ গ্রহণ করাকে মজুত মালের মাধ্যমে অর্থসংস্থান বলা হয়। এ ধরনের অর্থ সংস্থানের ক্ষেত্রে ঋণের অর্থ ফেরত না দেয়া পর্যন্ত মজুতপণ্যের উপর ঋণদাতার নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার বজায় থাকে।

ঘ) গ্রাম্য মহাজন

বহুকাল পূর্ব থেকেই গ্রামের বিত্তশালী ব্যক্তিরা স্বল্পমেয়াদে দরিদ্র ব্যক্তিদের ঋণ প্রদান করে আসছে। এক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে গ্রহীতাকে বড় অংকের সুদ প্রদান করতে হয়। আর সুদাসল প্রদানে ব্যর্থ হলে মহাজনরা ঋণগ্রহীতাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি দখল করে নেয়। গ্রাম্য মহাজনরা এ ঋণের উপরে দিনভিত্তিক, সপ্তাহভিত্তিক অথবা মাসভিত্তিক সুদ গণনা করে থাকেন।

Content updated By
Promotion